এম. এ ইসলাম:
দেশব্যাপী সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদানে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে প্রাইভেট ক্লিনিকের অবহেলা, ভুয়া চিকিৎসক আর অব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। চলতি মাসে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে দুই প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যত্রতত্র নামসর্বস্ব ক্লিনিক গড়ে ওঠায় এবং আর্থিকভাবে লাভবান হতে চিকিৎসকদের দৌরাত্বে এ উপজেলায় স্বাভাবিক প্রসব এখন ইতিহাসের পথে।
গত ৫ আগস্ট (শুক্রবার) গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সিটি জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে এবং ১৬ আগস্ট (মঙ্গলবার) হীরক ক্লিনিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে সি-সেকশন (সিজার) পরবর্তী দুই প্রসূতির মৃত্যু হয়। সিজারে শিশু দুটি বেঁচে থাকলেও মায়ের আদর স্নেহ থেকে থাকবে আজীবন বঞ্চিত। এ উপজেলায় নামমাত্র কাগুজে ডাক্তারে (অদৃশ্য চিকিৎসকে) চলমান ক্লিনিকগুলোতে অনকলে গাইবান্ধা-রংপুর-বগুড়া থেকে আসা চিকিৎসকদের দৌরাত্ব বেড়েছে। রোগীর শারীরিক অবস্থার কোন খোঁজ খবর না নিয়েই ভাড়ায় এসে রোগীর পেট কেটে প্রাপ্য বুঝে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। প্রসব বেদনা থেকে বাঁচতে আর নিরাপদে সন্তান জন্মের আশায় প্রাণ হারাচ্ছেন মায়েরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাভাবিক ও সি-সেকশন চালু থাকলেও ক্লিনিকে আগ্রহী চিকিৎসকদের রুখবে কে?
বলছি মাত্র ২৩ দিন আগে ৫ আগস্ট (শুক্রবার) জন্ম নেয়া আয়শা সিদ্দিকার কথা। মায়ের মৃত্যুতে এই শিশুটির ঠাঁই হয়েছে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার খলসী গ্রামে নানার বাড়িতে। অন্যদের ন্যায় জন্মের পর মা-বাবার আদর স্নেহ আর ভালবাসায় বেড় উঠার কথা ছিল তার। যেমন আদর তার ৫ বছর বয়সী ভাই পেয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরেই মা-হারা হয়েছে সে। সুস্থ্য ও সুন্দরভাবে গর্ভে থাকা সন্তান জন্ম নেবে এমন স্বপ্ন নিয়ে বে-সরকারি ক্লিনিকে প্রসবকালীন উন্নত চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয় আয়শা সিদ্দিকার মা মুনমুন (২৬)।
উপজেলার হাসপাতাল রোডের সিটি জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে ভর্তি হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের বুঝিয়ে সিজারে রাজী করায়। এজন্য পলাশবাড়ী থেকে আনা হয় অন কল চিকিৎসক জৈনক নুসরাতকে (অনকলে নিয়মিত ক্লিনিকগুলোর সার্জন)। তিনি এসে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা না করেই সিজার করে চলে যান। পরবর্তীতে রোগীর দেখভালে আবাসিক কোনো চিকিৎসক না থাকায় শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। বেগতিক অবস্থায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ রোগীকে বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে রেফার্ড করে। সেখানেই প্রাণ হারায় গৃহবধূ মুনমুন (২৬)। এতিম হয়ে যায় আয়শা সিদ্দিকা। এ ঘটনায় ওই দিনই রোগীর স্বজনরা মুনমুনের লাশ নিয়ে গভীর রাতে ক্লিনিকের সামনে প্রতিবাদ জানালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় ওঠে। স্বাস্থ্য সেবায় জেলা ও উপজেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্য’র কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি ওই ক্লিনিক ও চিকিৎসকের বিষয়ে কী প্রতিবেদন দিয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষই বা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা আজও জানে না কেউই।
আয়শা সিদ্দিকার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৬ আগস্ট (মঙ্গলবার) প্রসব বেদনা নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ হীরক ক্লিনিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে আসে ললিতা বেগম ও তার স্বজনরা। সকাল ৭টায় উপজেলার উত্তর বরট্ট হিন্দুপাড়া থেকে ক্লিনিকে এসে পৌঁছায়। কর্তৃপক্ষ অনকলে ডেকে আনেন চিকিৎসক মজিদুল ইসলামকে (উপজেলার বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে তার যাতায়াত)। তিনি বগুড়ায় অফিস করবেন; হাতে সময় কম; যত দ্রুত সি-সেকশন-তাতেই সুবিধা। রোগীর শারীরিক অবস্থার কোন খোঁজ খবর না নিয়েই তিনি সিজার করে কর্মস্থলে চলে যান। সিজারে ললিতা জন্ম দেন তার প্রথম পুত্র সন্তানকে। স্বামী চিরঞ্জিত ও আত্মীয়-স্বজনদের খুশির সীমা থাকে না।
কিন্তু অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে নেওয়ার পরে ললিতার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ক্লিনিকটিতে কোনো আবাসিক চিকিৎসক না থাকায় কর্তৃপক্ষ ও রোগীর স্বজনরা মুঠোফোনে চিকিৎসক মজিদুলের সাথে যোগাযোগ করে। তার পরামর্শে রোগীকে শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো যায়নি ললিতাকে। ওই রাতেই জয়পুরহাটে স্বামীর বাড়িতে দাহ সম্পন্ন হয়। সদ্য জন্ম নেয়া পুত্র সন্তান এখন ঠাকুরমা আর পিসিদের কোলেই বেড়ে উঠবে।
মেয়ের এমন মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছে না ললিতার মা আর বাবা রঘুনাথ। গুমরে গুমরে এখনও তারা কাঁদছেন। একমাত্র মেয়ে; সবেমাত্র ১ বছর হয়েছে মহা-ধুমধামে জৈষ্ঠ্যের শুভক্ষণে বিয়ে দিয়েছেন জয়পুরহাট জেলায়।
অকালে ঝড়ে পড়া ললিতার মা ক্যামেরার সামনে জানান, সিজারের আগে হীরক ক্লিনিকে আল্ট্রাসনো করার সময় দায়িত্বরত চিকিৎসককে ললিতার শ্বাস কষ্টের কথা জানাই। কিন্তু তারা বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত সিজার করানো নিয়েই ব্যস্ত ছিল। সিজারের পর একটি স্যালাইন না যেতেই মেয়ে আমার হিসকি পাড়তে থাকে। যত সময় যায়; ততই হিসকি পাড়া বাড়তে থাকে। তারা বগুড়ায় পাঠালেও আমার ললিতা বাঁচেনি।
ললিতার ভাই বউ জানান, গর্ভাবস্থায় আমরা চিকিৎসক মজিদুলের ব্যক্তিগত চেম্বার ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে ললিতার চেকআপ করিয়েছি।
এ বিষয়ে হীরক ক্লিনিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা রেজিস্ট্রার না দেখিয়ে জানান, রোগী বগুড়ায় মারা গেছে। তার বৈধ কাগজ আমাদের কাছে আছে।
অপরদিকে সি-সেকশন করানো চিকিৎসক মজিদুল ইসলামের সাথে ফোনে কথা বললে তিনি পরে কথা বলবেন জানালেও পরবর্তীতে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি বিষয়টি তার মুঠোফোনে ম্যাসেজে জানালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
এমন যখন অবস্থা তখন অনুসন্ধানে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবার ভঙ্গুর চিত্র ফুটে ওঠে। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে সিজারে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। তবে সব-সময়ই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অর্থের জোরে বিষয়গুলো ধামাচাপা দিয়ে আসছে। বে-সরকারি চিকিৎসাসেবার নামে উপজেলাজুড়ে চিকিৎসক ও ক্লিনিকগুলো যেনো কসাইখানা খুলে বসেছে। ফলে প্রতিনিয়ত প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ রোগীদের।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, চিকিৎসক মজিদুল ইসলাম আগে এ উপজেলার টিএইচও’র দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় উপজেলায় রাতারাতি ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তিনি নিয়মিত নিজ বাসায় রোগী দেখতেন আর এসব ক্লিনিকে অনকলে চিকিৎসেবা দিতেন। বর্তমানে তিনি Assistant Director DGHS, Dhaka. IHT Bogura-এ ৯ মার্চ, ২০২২ থেকে বর্তমান পর্যন্ত কর্মরত আছেন। সেখান থেকে প্রতিদিন অনকলে এখনও এসব ক্লিনিকে নিয়মিত যাতায়াত ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলার ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার নিয়মিত পরিদর্শন বা তদারকি নিয়ম থাকলেও তা চোখে পড়ে না। আর এই সুযোগে নামসর্বস্ব কাগুজে ডাক্তারের আড়ালে ক্লিনিকগুলো সেবা নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। আবাসিক চিকিৎসক নেই, নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ নার্স। প্রসূতি আসলেই বাচ্চা উপরে উঠে গেছে, পানি শূন্য হয়ে পড়েছে, বাচ্চা উল্টে গেছে ইত্যাদি মনগড়া কথা বলে তারা সি-সেকশনে রাজি করায়। এর ফলে উপজেলাজুড়ে ইতিহাসের পাতায় এখন স্বাভাবিক ডেলিভারি। তবে সরকারি হাসপাতাল ও হাতে গোনা কয়েকটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক ডেলিভারির চেষ্টার কথা জানা গেছে।
গোবিন্দগঞ্জে বে-সরকারি স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে নাগরিক কমিটির আহবায়ক এম এ মতিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, রাতারাতি বিভিন্ন এলাকায় নাম সর্বস্ব ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সেবার নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সারি সারি ক্লিনিকের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার রাস্তাটিও মানুষ ভুলে যাচ্ছে। আর এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় মানুষদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বে-সরকারি চিকিৎসার মানোন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল, চিকিৎসা সামগ্রী নিশ্চিতকরণ সহ দায়ী চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবেন এমনটি দাবি জানান তিনি।