এম.এ ইসলাম:
বারো মাস নদী ও ভ‚-গর্ভস্থ বালু উত্তোলন-বিপণন ও পরিবহন কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে বালু দস্যুরা। গ্রাম ও শহরে সড়কের পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোকে করছে শ্রীহীন। আপামর মানুষের প্রতিবাদ শোনেনি কেউ। আশ্বাস দিলেও কথা রাখেনি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এখন বর্ষা মওসুম শুরু হয়েছে। নদী ও খাল-বিলে ভরা যৌবনের হাতছানি। বৃদ্ধি পাচ্ছে পানি ও স্রোতের গতি। নদী তার নাচের তালে তালে ভাঙ্গছে দু’পার। নদী পারের গ্রাম রক্ষায় মানববন্ধন হলেও নদী তার রাক্ষুসী স্বভাবে গিলে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ঠিক যেভাবে বালু ব্যবসায়ীরা অবজ্ঞা করেছে আম-জনতার প্রতিবাদ। এখন তাই ‘দুস্যরা বালু আর নদী গিলছে গ্রাম’।
এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার করতোয়া-কাটাখালী-বাঙ্গালী নদী পারের গ্রামের পর গ্রামে। উপজেলার কাটাবাড়ী-সাপমারা-দরবস্ত-তালুককানুপুর-ফুলবাড়ী-রাখালবুরুজ-হরিরামপুর-মহিমাগঞ্জ (৮টি) ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কোথাও করতোয়া, কোথাও কাটাখালী আর বাঙ্গালী নদী।
সম্প্রতি এ ইউনিয়নগুলোর বোচাদহ, জিরাই, বামনহাজরা, চর বালুয়া, হরিনাথপুর (বিশপুকুর নয়াবাজার), পারসোনাইডাঙ্গা, সরকারপাড়া, ধর্মপুর-কাজলা, চাঁদপুর সিংগা, উত্তর ছয়ঘড়িয়া, বড় নারায়নপুর, সুন্দইল, পার্বতীপুর-শ্যামপুর, ফতেউল্ল্যাপুর (রায়ের বাড়ি), বড় রঘুনাথপুর, চণ্ডিপুর তাজপুর, দিঘলী ফুলবাড়ী, হাতিয়াদহ, বালেমারি, খলসি, চাঁদপুর-খলসি, তালুকরহিমাপুর, নরেঙ্গাবাদ, ফুলাহার ও তরফমনু নদীতীরবর্তী গ্রামবাসীরা ভাঙন আতঙ্কে ভ‚গছে। কিছু কিছু পয়েণ্টে ইতিমধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কিছু পয়েণ্টে বসতবাড়ি ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীপারের অসহায় মানুষগুলো গুমরে কাঁদছে; কোথাও তারা একত্রিত হয়ে বসতভিটা রক্ষায় মানববন্ধন করছে।
দেশে নাগরিক অধিকার আর জীবনমাল রক্ষায় রয়েছে প্রচলিত আইন-সরকার-প্রশাসন। এদের সবকটি দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত। তবুও নদীতীরের এঁরা অবহেলিত। এর কারণ কি তবে উপজেলার বালু দস্যুরা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বর্তমান সরকারের আগের ১৩ বছরে সারাদেশে সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছিল। সেখান থেকে এ সরকারের শাসনামলে তা সাড়ে ৩ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। এ সরকার যেমন উন্নয়ন সূচকের সর্বোচ্চ স্তরে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে; পাশাপাশি যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম আমাদের এই অবহেলিত উপজেলাটি।
এখানকার বালু ব্যবসায়ীরা পাশের বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় নানা উন্নয়ন কাজে বালু সরবরাহ করেছে এবং করছে। এখনও বালু যাচ্ছে বগুড়া- জয়পুরহাট আর দিনাজপুরে। এ উপজেলার করতোয়া-কাটাখালী-বাঙ্গালী নদী সহ ভ‚-গর্ভস্থ যত্রতত্র বালু উত্তোলনের ফলে নদীগর্ভে শত শত হেক্টর আবাদি জমি রক্ষায় সরকারের পানি উন্নয়নবোর্ডের গ্রহীত সকল পদক্ষেপ ভেস্তে যেতে বসেছে। বর্ষা মওসুমের শুরুতেই প্রায় নদী তীরবর্তী ২০টি পয়েণ্টের বসবাসকারীরা রয়েছে চরম আতঙ্কে।
এদেরই একটি পয়েন্টের প্রতিনিধি মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বামন হাজরা গ্রামবাসী। তাদের অনেকেরই বসতভিটা-আবাদি জমি ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বসতভিটায় স্পষ্ট হয়েছে ফাটল চিহ্ন। নিরুপায় এ জীবনগুলো সহায়-সম্বলটুকু নিয়ে বাঁচার তাগিদে নদীতীরে করেছে মানববন্ধন। বাঙ্গালী নদীর ভয়াল ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষায় এলাকাবাসী জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বলতে গেলে এ এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে বালু দস্যুরা নির্বিচারে বালু উত্তোলন-বিপণন-পরিবহন করায় নদীর স্রোতধারা পরিবর্তিত হয়েছে। সম্প্রতি সেখানে সরকারি একটি প্রকল্প চালু থাকলেও রক্ষা পাচ্ছে না এ গ্রামটি। অনেকের ধারনা এ মওসুম শেষ নাগাদ গ্রামটি পূর্বে বিলীন হওয়া গ্রামগুলোর মতই হবে।
সবশেষে তাই বলতে হয়- উন্নয়ন কাজে বালু লাগে। নিজ জেলার উন্নয়নে সেখানকার বালু ব্যবহার করাই উত্তম। সেক্ষেত্রে পাশের ছয়টি জেলার উন্নয়নের ধোঁয়া তুলে এ এলাকার বালু দিয়ে নদী তীরের অসহায় মানুষগুলোকে নিঃস্ব করে কতিপয় সুবিধাভোগীর পকেট ভারির মানসিকতায় পরিবর্তন প্রয়োজন। তবেই আতঙ্ক থেকে রক্ষা পাবে উপজেলার শত শত নদী তীরবর্তী পরিবার। সর্বোপরি গোবিন্দগঞ্জ থেকে বন্ধ হোক বালু উত্তোলন-বিপণন-পরিবহন। জয় বাংলা।