1

গাইবান্ধায় দেশী মদের দোকান, অধিদপ্তরের নিয়ম-নীতি মানছে না

গাইবান্ধায় দেশী মদের দোকান
* নির্দিষ্ট দিনেও থাকছে না বন্ধ;
* মূল পয়েণ্টের বাহিরেও চলছে বেচা-কেনা;
* প্রকৃত সেবীর সংখ্যা নিবন্ধিত’র পাঁচ গুণ;
* রয়েছে পরিমাণে কম দেয়া ও মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ;

এম.এ ইসলাম:
গাইবান্ধা জেলায় অবস্থিত লাইসেন্স প্রাপ্ত দেমী মদের দোকানগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বেঁধে দেওয়া নিয়ম-নীতি মানছে না। ধর্মীয় উৎসব বা দিবসগুলোর পাশাপাশি শুক্রবারেও বন্ধ থাকে না। মূল দোকান ও অন্যান্য পয়েন্ট থেকে ‘র’ এবং ‘লুস’ মাল ক্রয় করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। জেলায় নিবন্ধিত মদ সেবীর সংখ্যার চেয়েও প্রায় পাঁচ গুণ বেশি ব্যক্তি নিয়মিত মদ পান করছে। খোদ লাইসেন্স প্রাপ্ত দোকানগুলোতে ইচ্ছামত মূল্যবৃদ্ধি নয়ত পরিমাণে কম দেওয়ার অভিযোগে তুলছেন নিয়মিত মদ পানে আসক্ত ব্যক্তিরা। তাদের কথায়- ‘আমাদের দিকে কে দেখবে; ওরা ওদের ইচ্ছামত বাহানায় দাম বাড়াচ্ছে; নয়ত পরিমাণে কম দিচ্ছে।’

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গাইবান্ধা সদর, পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়িতে লাইসেন্সকৃত পাঁচটি দেশী মদের দোকান রয়েছে। নিবন্ধনকৃত সেবনকারীদের মধ্যে গাইবান্ধা সদরে রয়েছে ১০৬০, পলাশবাড়ী ১২০, গোবিন্দগঞ্জে ২০০, সাঘাটায় ১৪০ ও ফুলছড়িতে ১৯০ জন রয়েছে। জেলায় সর্বমোট ১৭১০ জন ব্যক্তি মদপানে লাইসেন্স গ্রহণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মদের দোকানগুলোতে দিন ও রাতের আনাগোনা থেকে এ সংখ্যাটা প্রায় দশ হাজারের ওপরে।

আমাদের কথা হয় একাধিক নিয়মিত মদ পানে আসক্ত ব্যক্তিদের সাথে। তারা জানান, সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকাসক্ত কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ রয়েছে। ইদানিং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত যাতায়াত করছে। সম্প্রতি দেশের বাজারে ফেন্সিডিল, হিরোইন ও ইয়াবা’র মূল্য বৃদ্ধি ও বাজার সংকট হওয়ায় এরা দেশি মদের দোকানগুলোতে ভিড় করছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকরাও রাতের আঁধারে এসব দোকানে আসে; নয়ত লোক মারফত বাহিরে নিয়ে মদ পান করছে।
তারা আরও জানায়, আমরা অনেকেই মদপানের লাইসেন্স করি নি। ভাটিখানায় কথা বলেছি, ওরা করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু দোকানগুলোতে আমাদের সংখ্যাই বেশি। লাইসেন্স আছে কয় জনের। এ কারণেই ওরা ইচ্ছামত মদের দাম বাড়ায়। আগে এক গ্লাস মদ ছিল ৮০-৯০ আর একটি ২৫০মি.গ্রাম স্প্রিড বোতলের দাম ছিল ১০০ টাকা। কিছু দিন হচ্ছে দোকানিরা তা ১০০ ও ১২০ টাকা নিচ্ছে।

এদিকে ভাটিখানার সাথে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, এক লিটার ‘র’ বা কড়া মদ ৮০০ টাকায় কিনে এক হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তবে বাহিরে লুস মাল ৪৫০ টাকায় কিনে অনেকেই ব্যবসা করছে। গোবিন্দগঞ্জ সহ অন্যান্য উপজেলাতেও নির্দিষ্ট মদের দোকান এবং বিভিন্ন উপজাতী পল্লী বা বাঁশফোরদের কাছ থেকে কেউ কেউ নিম্নমানের মদ কিনে বিভিন্ন স্থানে চড়া দামে বিক্রি করছে। যেখানে মদের কোনো মান যাচাই করা হয় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিগত সময়ের মত হঠাৎ করেই অনেক প্রাণ ঝড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ৫টি দেশী মদের দোকানগুলো হল- কনক কান্তি সরকার নামীয় গাইবান্ধা সদর, রাইসেন্স নম্বর ০২/৭৭-৭৮; মো. সাহাব উদ্দিন ও মো. সাব্বির মিয়া নামীয় ফুলছড়ি, লাইসেন্স নম্বর ১৪/৭৭-৭৮; রাজেন্দ্র প্রসাদ (মৃত্যু) ও নিলিমা প্রসাদ নামীয় বোনারপাড়া ষাঘাটা, লাইসেন্স নম্বর ০৮/৭৬-৭৭; শ্রী মিঠু কুমার দে ও শ্রী অমিত কুমার দে নামীয় কালীবাড়ী রোড, পলাশবাড়ী, লাইসেন্স নম্বর ১২/৭৭-৭৮; রামা শংকর প্রসাদ ও রিপন প্রসাদ নামীয় গোবিন্দগঞ্জ বাজার, লাইসেন্স নম্বর ০৯/৭৭-৭৮। বর্তমানে এগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধায় পয়লা বৈশাখের প্রাক্কালে বিষাক্ত মদ পান করে ৭১ জনের প্রাণহানি হয়। তৎকালীন পুলিশ সূত্রগুলো জানায়, ওই ঘটনা তদন্তে জানা যায় গাইবান্ধার রিপা হোমিও হলের মালিক রবীন্দ্রনাথ সরকারের কাছ থেকে স্পিরিট কিনে পান করেছিলেন তাঁরা। অভিযোগ উঠেছিল বগুড়ার বিখ্যাত পারুল হোমিও ল্যাবরেটরির তৎকালীন মালিক নূর মোহাম্মদ রবীন্দ্রনাথ সরকারকে ভেজাল মদ জোগান দিয়েছেন।

২০১৪ সালের ৯ আগস্ট গোবিন্দগঞ্জের পৌর এলাকার কসাইপাড়ায় বিষাক্ত চোলাই মদপানে গোবিন্দগঞ্জ পৌর এলাকার জহুরুল ইসলাম, টাঙ্গাইলের রিপন মিয়া ও মোকামতলার স্বপন মিয়া সহ তিনজনের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ২২ জুলাই বিষাক্ত মদ পানে পাঠানপাড়ার মেহেদী হাসান সোহাগ, ঝিলপাড়ার তৌফিকুজ্জামান সৈকতের মৃত্যু হলেও প্রাণে রক্ষা পায় রানা, বাঁধন সরকার, বাপ্পী, অভি সহ পাঁচ জন।

২০১৫ সালের ১ মার্চ পলাশবাড়ী উপজেলায় কোমরপুর বাজার এলাকার ভগবানপুর গ্রামের মোহনলাল রবিদাসের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে ভগবানপুর গ্রামের মোখলাল রবিদাস, বগুড়া সদরের রবিলাল রবিদাস ও রংপুর সদরের ভাসানী রবিদাস সহ তিনজনের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশে মদ্যপানের নতুন বিধিমালায় যা রয়েছে:
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সম্প্রতি ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২’ জারি করেছে। এটি ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’-এর অধীনে করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো অ্যালকোহল বা মদ উৎপাদন, কেনাবেচা, পান করা, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি স্পষ্ট করা হয়। এর আগে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’, ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ (লাইসেন্স ও পারমিট ফিস) বিধিমালা ২০১৪’, ‘মুসলিম প্রহিবিশন রুল ১৯৫০’ ও ‘এক্সাইজ ম্যানুয়াল (ভল্যুম-২)’ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অ্যালকোহল সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো।

দেশি মদের দোকান খুলবে বেলা ১১টায়। বন্ধ হবে ১৬ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত রাত ৯টায় এবং ১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত রাত ৮টায়।

লাইসেন্স বা অনুমোদন ফি এবং এগুলোর নবায়ন ফি নতুন করে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এই বিধিমালায়। দেশি মদপানের অনুমোদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ টাকা। বিদেশি মদপানের অনুমোদন ফি তিন হাজার টাকা। শুক্রবার, মহররম, শবে বরাত, ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে কদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা এবং সরকার নির্ধারিত দিনে অফ শপ, অন শপ ও দেশি মদের দোকান বন্ধ রাখার বিধান রেখে বিধিমালা হয়েছে।

উল্লেখিত বিধিমালার অনেকটাই মানা হচ্ছে না গাইবান্ধায়। দেশে মদ উৎপাদন ও সরবরাহে একমাত্র প্রতিষ্ঠান ‘কেরু অ্যান্ড কোম্পানি’ থাকলেও বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র দেশী মদ তৈরি হচ্ছে। বাহির থেকে নিম্ন মানের মদ কিনে তা বিক্রি করে অনেকেই লাভবান হচ্ছে। জেলাজুড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।