এম. এ ইসলাম:
শান্তি বিরাজমান ইউরোপে আজ যুদ্ধের দামামা। আধুনিক সমরাস্ত্রের আঘাতে ঝড়ছে হাজার হাজার প্রাণ। অশান্ত হয়ে ওঠার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব। কিন্তু কী এমন স্বার্থ জড়িয়ে আছে যে, পূর্বে একত্রে থাকা দেশ দুটি আজ নিজেদের মধ্যে হানাহানি শুরু করেছে। নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের দিকে।
যুদ্ধ শক্তির মানদণ্ডে একজন আরেক জনের থেকে যোজন দূরত্বে অবস্থান করলেও কেউ যেমন পরাজয় স্বীকার করেনি; তেমনি দীর্ঘ ১০দিন শেষেও কেউ জয়ী হয়েছে বলতে পারছে না। সমর শক্তিতে ক্ষুদ্র দেশটি বিশ্বের প্রথম স্তরের আঘাত সহ্য করেও এখনও প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। তবে ইউক্রেন কী নেপথ্য শক্তি হিসেবে ন্যাটোর অংশগ্রহণের অপেক্ষায় আছে? যদি তাই হয়; রাশিয়া কীভাবে ন্যাটোকে মোকাবিলা করবে?
ইতিমধ্যে ন্যাটোভুক্ত দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার ওপর সবধরনের চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। তারপরেও রাশিয়া কর্ণপাত করছে না কেন? নিজ শক্তিতে বলীয়ান বলে। নাকি তারাও ন্যাটোকে মোকাবেলায় নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাউকে রেখেছে। যদি তাই হয় তবে সেটা হবে এসসিও। যার দ্বারা ন্যাটোকে সমুচিত জবাব দেওয়ার অপেক্ষা করছে। এমনটা ঘটলে সেটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোড় নেবে।
ন্যাটো (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা) সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারনা অনেকটাই পরিস্কার। ১৯৪৯ সালে যাত্রা শুরু করে আজ তাদের সদস্য দেশ ৩০। প্রতিষ্ঠাতা দেশ ১২টির মধ্যে রয়েছে- বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইটালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- গ্রীস, তুরস্ক, জার্মানী, স্পেন, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, এস্তানিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মন্টিনিগ্রো ও সর্বশেষ যুক্ত উত্তর মেসোডেনিয়া। একসময় ইউরোপ জুড়ে সোভিয়েত আগ্রাসনে ভীত থেকেই এই সামরিক জোটের উৎপত্তি। এর মূল উদ্দেশ্য তিনটি- এক. রাশিয়ানদের দূরে রাখা; দুই. আমেরিকানদের কাছে আনা এবং তিন. জার্মানদের দাবিয়ে রাখা।
জন্মের পর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তারা একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে একের পর এক দেশকে। জোটকে শক্তিশালী করতে সদস্য দেশ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পরিণত ও পরিক্ষিত বিশ্ব শক্তি এখন তারা। সেদিক থেকে বিশ্ববাসীর কাছে অনেকটাই অপরিণত ও দুর্বল এসসিও। এসসিও সম্পর্কে যদি বলতে হয়, তবে যেটুকু না বললেই নয়। রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে ন্যাটোর আদলে গড়ে উঠে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন) এসসিও। এটি ইউরেশীয় রাজনীতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংস্থা। ২০০১ সালের ১৫ জুন গঠিত হলেও সনদ সই হয় ২০০২ সালে এবং কার্যকর হয় ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে। শুরুর দিকে স্বাগতিক চীন ছাড়াও সদস্য ছিল কাজাখাস্তান, কিরগিজস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান।
২০১৭ সালের ৯ জুন যোগ দেয় ভারত ও পাকিস্তান। এই আট স্থায়ী সদস্যর পাশাপাশি চারটি রাষ্ট্র আফগানিস্তান, বেলারুশ, ইরান ও মঙ্গোলিয়াকে রাখা হয় পর্যবেক্ষক সদস্য। আর সংলাপ সহযোগী ছয়টি দেশ দেশ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও তুরস্ক রয়েছে। এ সংগঠনটিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকে জাতিসংঘ, আসিয়ান, সিআইএস ও তুর্কমেনিস্তান। মূলত মধ্য এশীয় দেশগুলোর নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ থেকেই এ সংস্থার জন্ম। কিন্তু এসসিও বা ন্যাটো কোনোটিতেই নেই আমাদের বাংলাদেশ।
এসসিওর লক্ষ্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা আর প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কার্যকর সহযোগিতা জোরদার, মিলিতভাবে বিশ্ব আর আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রচেষ্টা চালানো এবং গণতান্ত্রিক, ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির নতুন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। মজার বিষয় হলো যুক্তরাজ্যও একসময় এর সদস্য পদ লাভে আবেদন করে। যা ২০০৬ সালে নীতিগত আদর্শে মিল না থাকায় বাতিল করে দেওয়া হয়।
ন্যাটো দীর্ঘ সময় ধরে এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে বেশ কিছু মিশন পরিচালনা করছে। আফগানিস্তানে সুরক্ষা সহায়তা, কসোভোতে শান্তিরক্ষা মিশন, ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা টহল, সোমালিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন বাহিনীকে সমর্থন প্রদান, পূর্ব ইউরোপের আকাশে নজরদারি এবং ইরাকে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া-ইত্যাদি। সেদিক থেকে এসসিও অনেকটাই নবীন। নিজেদের মধ্যে সামরিক মহড়া ব্যতীত এ পর্যন্ত তারা কোনো যুদ্ধে অংশ নেয়নি। সেদিক থেকে এবার ন্যাটো ও এসসিও যুদ্ধে জড়ালে ধ্বংসস্তুপের মাঝ থেকে কে আগে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তা দেখবে বিশ্ব।
এবার আসা যাক বর্তমান সময়ে এমন অবস্থা সৃষ্টির প্রেক্ষাপট। সোভিয়েত রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধে ১৫টি প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলো হলো- ১. আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ২. আজারবাইজানি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৩. বেলারুশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৪. এস্তোনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৫. জর্জীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৬. কাজাখ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৭. কিরগিজ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৮. লাটভীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ৯. লিথুয়ানীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ১০. মলদোভীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ১১. রুশ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ১২. তাজিক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ১৩. তুর্কমান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র; ১৪. ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও ১৫. উজবেক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। যেখানে আমেরিকা এদের অনেককেই ন্যাটোভুক্ত করতে সফল হয়েছিল।
পরবর্তীতে ইউরোপে একাকি রাশিয়া ন্যাটোর কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এক সময় রাশিয়া আমেরিকাকে বিশ্বাসঘাতক ভাবতে থাকে। কেননা ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর আমেরিকা পূর্বদিকে অগ্রসর না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ২০০৮ সালে ন্যাটোর বুখারেস্ট সম্মেলনের পর, আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। রাশিয়া বুঝতে পারে জর্জিয়া এবং ইউক্রেনকে জোটের অন্তর্ভুক্ত করা অর্থ শত্রুতা সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে আসতে যাচ্ছে ন্যাটো। বিষয়টি স্পষ্ট করতে রাশিয়া আমেরিকা তথা ন্যাটোকে চাপ দিতে থাকে। তারা যেন ইউক্রেনকে তাদের জোটে না নেয়। কিন্তু ন্যাটো ইউক্রেনকে টানতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
রাশিয়া ইউক্রেন সরকারকে বিরত রাখার ক‚টনৈতিক চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ভবিষ্যত অন্ধকার ভেবে দেশটির সরকার উৎখাতে আক্রমণ করে বসে। যে যুদ্ধ এখনও চলছে। আর এর শেষ দেখতে নানা হিসাব কষে ক্লান্ত বিশ্ববাসী অজানা আশঙ্কায় রয়েছে।
পরিশেষে বলতেই হয়, নিজেদের শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে মানবতা ধ্বংস হবে; এটা কারও কাম্য হতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ক‚টনৈতিক সমঝোতায় বিশ্ববাসী এর অবসান চায়। মারণাস্ত্র নয় দেশে দেশে সম্প্রীতি আর ভালোবাসার ফুল ছোড়া হোক। আগামীর বিশ্ব শঙ্কামুক্ত থাক। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এমন স্লোগানে মানবতার জয় হোক।